প্রকাশের তারিখ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫
ফিশারিঘাটে জলদস্যু সিন্ডিকেটের দাপট, আ.লীগ নেতা টুলুর সাম্রাজ্যের হাল ধরেছে বাচ্চু!
প্রকাশের তারিখ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫
কক্সবাজার ফিশারিঘাট এক সময় যেখানে ভোরের আলোয় ভেসে উঠত জেলেদের হাসি আর জালে ধরা মাছের ঝলকানি, আজ সেখানে প্রতিধ্বনিত হয় রাজনীতি, চাঁদাবাজি আর ভয়ভীতির গল্প। সমুদ্রের বুকে জেলেদের জীবিকার এই ঘাট এখন রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক দখল আর সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘরে।
এক সময়ের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ওসমান গনি টুলু ছিলেন এই ফিশারিঘাটের ‘অঘোষিত সম্রাট’। ঘাটে তার অনুমতি ছাড়া কোনো ট্রলার ভিড়ত না, মাছ নামানো দূরের কথা। সরকার পরিবর্তনের পর তিনি এখন আত্মগোপনে। তবে তার প্রভাবের সাম্রাজ্য আজও টিকে আছে—শুধু মুখ বদলেছে।
এখন ঘাটের নিয়ন্ত্রণে টুলুর ভাই, সদ্য বিএনপি নেতা হয়ে ওঠা নাসির উদ্দীন বাচ্চু। ফিশারিঘাটের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ‘নিশান এন্টারপ্রাইজ’ নামের ছোট্ট এক ব্যবসা থেকে রাজনীতির হাত ধরে টুলু গড়ে তোলেন বিশাল এক সাম্রাজ্য। স্থানীয় জেলেরা জানান, টুলুর অনুমতি ছাড়া কোনো ট্রলার নোঙর ফেলতে পারত না। প্রতি ট্রলার থেকে আদায় হতো নির্দিষ্ট হারে টাকা। টাকা না দিলে মারধর, ভাঙচুর ও ট্রলার হারিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটত।
এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টুলুর নাম শুনলেই বুক কেঁপে উঠত। তার লোকজন ঘাটে পাহারার মতো ঘুরত। টাকা না দিলে মাছ নামাতে দিত না। কখনও ট্রলারও হারিয়ে যেত।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, টুলুর প্রভাব শুধু স্থলে নয়, সমুদ্রের ঢেউ পেরিয়েও বিস্তৃত ছিল। মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার উপকূলে সক্রিয় দস্যু ফারুক মাঝি, নাছিম মাঝি ও খায়রুল আমিনের নেতৃত্বে চলত ট্রলার লুট। এসব দস্যুদের লুটের মাছ নিয়মিত বিক্রি হতো টুলুর নিয়ন্ত্রিত ফিশারিঘাটে। এক ট্রলার মালিক জানায়, আমরা জানতাম কার কাছে লুটের মাছ বিক্রি হয়। কিন্তু মুখ খুললে সাগরে নামা বন্ধ করে দিত।
অভিযোগ আছে, এসব লেনদেনের অংশ বিশেষ প্রশাসনের প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তার পকেটেও যেত।
এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওসমান গনি টুলু হঠাৎ আড়ালে চলে যান। চেহারায় দাঁড়ি, পোশাকে পরিবর্তন, তবু টুলুর ছায়া ঘাট থেকে সরেনি। এখন সেই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে তার ভাই নাসির উদ্দীন বাচ্চু, যিনি সরকার পরিবর্তনের পর হঠাৎ বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
স্থানীয়রা বলেন, আগে আওয়ামী লীগ টুলুর নামে চলত, এখন বিএনপি বাচ্চুর নামে চলে। ঘাটের রঙ বদলেছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ বদলায়নি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেলে জেলে একরামুল হকের ট্রলার দস্যুরা লুট করে নিয়ে যায়। স্থানীয়রা দস্যুদের চিনলেও মহেশখালী থানায় কোনো মামলা রেকর্ড হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, টুলু-বাচ্চু সিন্ডিকেট থানায় মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মামলা ঠেকিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীরা বিক্ষোভ মিছিল করলেও এখনও কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এ নিয়ে জেলেদের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ভুক্তভোগী জেলেরা বলছেন, ফিশারিঘাটের এই চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি ও দস্যুতার সিন্ডিকেট স্থানীয় প্রশাসনের নীরব সমর্থন ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ পাঠানো হলেও এখনো কোনো তদন্ত বা পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
এক জেলে কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলেন, আগে আওয়ামী লীগ টুলুর দাপটে ভয় পেতাম, এখন বিএনপি বাচ্চুর দাপটে ভয় পাই। শুধু নাম বদলেছে, ভয় নয়। কক্সবাজার ফিশারিঘাট আজ রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বন্দি।
ওসমান গনি টুলুর হাত থেকে শুরু হয়ে এখন নাসির উদ্দীন বাচ্চুর নিয়ন্ত্রণে থাকা এই সিন্ডিকেট কেবল রাজনৈতিক পতাকা বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি।
ভয়, নির্যাতন, দস্যুতা ও চাঁদাবাজির অন্ধকারে জেলেদের জীবন ও জীবিকা আজও বন্দি।
এ বিষয়ে টুলুুর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, অনুসন্ধানের ২য় পর্বে থাকছে টুলু-বাচ্চু সিন্ডিকেটের অর্থপাচার, প্রভাবশালী ছত্রছায়া ও ঘাটের গোপন অর্থনৈতিক জাল নিয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন।
সম্পাদক ও প্রকাশক : আব্দু শুক্কুর
নির্বাহী সম্পাদক: রকসী সিকদার
পরিচালনা সম্পাদক : ইকবাল চৌধুরী
বার্তা সম্পাদক : আব্দুল্লাহ আল ফরহাদ
কপিরাইট © ২০২৫ দৈনিক বাংলাদেশ । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
আপনার মতামত লিখুন